29 Aug, 2016 * Editor: Dipankar Dutta * Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in * Mobile: 9891628652 * Delhi

রবীন্দ্র গুহ

বাংলা সাহিত্যের ঈশা মসীহ : সমীর রায়চৌধুরী




পাটনার ইমলিতলার প্রসঙ্গ উঠলে সমীরের গল্প বলা থামতো না।

ইমলি কথাটায় আমারও কিঞ্চিৎ আকর্ষণ আছে।  ইমলি বৃক্ষের পাতা খুব ক্ষুদে ক্ষুদে। আমার একটি কবিতার নাম --'ইমলি পাতায় হাতীর নাচন'। ইমলি গাছের ডালে পা ছড়িয়ে শাঁকচুন্নী 'হাঁহাঁ-হিঁহিঁ' করে।  আর তলায় নাচানাচি করে ভূতনিরা। সেই ইমলিতলায় প্রথম চোখ মেলে সমীর রায়চৌধুরী।  তার খানিক দূরে দরিয়াপুর।

দরিয়া মানে কি ? নদী।  এ-নদীতে জল নেই -- কিলবিল করে নাঙ্গা, খোঁড়া, ঠুঁটো-মানুষ, আধা-মানুষ -- আর খেঁয়ো-কুকুর-বিড়াল-শুয়োরের পাল।  মেয়েমানুষের কথা তো আসেই না, পুরুষরাও রেলে চড়েনি, ইস্কুলে যায় নি। সেই ইমলিতলার জাঁতিকলের যুবক কলকাতা এলো -- এখান থেকে মুম্বাই ফের কলকাতা।  কয়েকজন বন্ধু জুটে গেল - যারা নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। এইমাত্র মনে পড়ে গেল কয়েকজনের নাম -- কাঞ্চন মুখার্জী, দ্রোণাচার্য ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। দ্রোণাচার্য পুলিশের গুলিতে মরলো।

লিডারগিরি বা আখের গোছানোর ধান্দা কোন কালেই ছিল না।  তাই রাজনীতি থেকে সরে এলো। যদিও সবাইকে সমীর নানা ভাবে উৎসাহিত করতো।  তারা তাঁকে পছন্দ করতো না।

- কিন্তু হাংরি আন্দোলনের তো ফাদার ফিগার ছিলে তুমি ?

- না, সে অর্থে মলয় ছিল হাংরির ফাদার ফিগার। যদিও মেনিফেস্টোতে 'নেতৃত্ব : শক্তি চট্যোপাধ্যায়' বলে লেখা হয়েছিল।

বুলেটিন বিলি হতো কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে।  যৌনরোগ তথা গুপ্তরোগের হ্যান্ডবিলের মত।  তাই নিয়ে কফিহাউসে খুব হাসাহাসি হত।  মজা হত। অন্যরা আড়ালে।  সমীরের পরিচিত।

- জানি, নিন্দুকদের দলের পাণ্ডা শরৎ-সুনীল।  মানে কৃত্তিবাসের মসিহস্তীরা।

- তুমিও তো কৃত্তিবাসের একজন ছিলে।  সুনীলের প্রথম কবিতার বইয়ের প্রকাশক।  সত্যি করে বলো, প্রকাশনার খরচ  দিয়েছিল ?

- সুনীল।  ও একটা সংবাদপত্রের প্রুফ রিডার ছিল।  সেখান থেকে কিছু টাকা পেয়েছিল।

- তোমরা বরাবর বলে আসছ শরৎ-সুনীল-শক্তি তোমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এসেছে।  এরকম সন্দেহের কারণ কি ?

- সুনীল-শক্তি খুব ভিনডিকটিভ ছিল।  ওরা সবাই চাইত - কোন পত্রিকায় আমার লেখা যেন ছাপা না হয়।  হ্যাঁ, ওদের নিজেদের মধ্যেও রেষারেষি ছিল। ভাঁড়ে দেশি মদ খেয়ে কবিতা নিয়ে কথা বলতে বলতে শক্তি সহসা সুনীলের পোঁদে ক্যাঁক করে লাথি মারে।  দেশপ্রিয় পার্কে বসে আড্ডা দেবার সময় দুজনের মধ্যে তুমুল তর্কাতর্কি হয় এবং হাতাহাতি।

- কিন্তু শক্তি তো ভীরু-প্রকৃতির ছিল ?

- তা ছিল।  সব সময় ভাবত বন্ধুরা ওকে জাঁতিকলে ফেলবে।

- শুনেছি তোমার শালীর সঙ্গে শক্তির প্রেম ছিল।

- হ্যাঁ শক্তি খুব লোভী-স্বার্থপর ছিল। আমি যখন চাইবাসায় ছিলাম, শক্তি আমার কাছে দেড় বছরের বেশি ছিল।  আমার শালীর সঙ্গে প্রেম করতো। আমার পয়সায় মদ খেত।  আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে নানান পত্রিকায় কবিতা পাঠাবার জন্য ডাকটিকিট কিনত। অবশ্য, অনেক সময় ছোট ছোট পত্রিকায় টিকিট ছাড়াই কবিতা পাঠিয়ে দিত।  খামের মুখ খোলা থাকত। যেহেতু শক্তির কবিতা, সম্পাদকেরা বেয়ারিং চিঠি ছাড়িয়ে নিত।

কালখণ্ডের বাঙালির পতন কবে থেকে শুরু জানো ? - প্রশ্ন করল সমীর।
উত্তরও দিল সমীর - যেদিন থেকে বাঙালির মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয় সে সেরা বুদ্ধিজীবী।

বন্ধুদের একজন বলল - না, যেদিন জানা গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছেন। বাঙালির মগজে বিস্তর স্বপ্ন হুমড়ি খেল।  অবচেতনায় হীনতা, অনাধ্যাত্ম, অতিপক্কতা। যাকিছু ঘটার তখন থেকেই ঘটেছে। এখন তলানিতে এসে ঠেঁকেছে।

আমরা ব্যাপারটা টের পেলাম সমীরের অবাক করে দেওয়া গদ্য 'আরেক রবীন্দ্রনাথ' পড়ে। কে ঔপন্যাসিক থেকে পেজ থ্রি সেলিব্রিটি হল সেটা কোন ফ্যাক্টর নয়, কবি হতে-হতে নেতা হয়ে যাওয়াটাও এই পতনের মুখে গরু গাছে ওঠার সামিল।

- এই সময়কার মানুষদের ব্যক্তিগত চরিত্রে গন্ডগোল আছে।  থাকবেই। এটাই খাঁটি অধুনান্তিক রিয়্যালিটি - ট্রু-ইজম। কি মনে হয় তোমার ?

- দ্যাখো রবীন্দ্র, আমি সেল্ফ মেড মানুষ, শৈশব কেটেছে মুসলমান পাড়ায়, কৈশোর অতিপিছড়ে বর্গের সাথে, চাকরিতে বন্ধু জুটেছিল মাদ্রাজি, গুজরাতি, হরিয়ানভি, পাঞ্জাবী - তারা সবাই আধা শিক্ষিত, তাই মানুষের দ্বিপাক্ষিক ব্যক্তিগত চরিত্রের গন্ডগোলটা বুঝি। সুতরাং আরোপিত কোন ব্যাপার নেই। খুব কাছের মানুষের যৌনাচার দেখেছি। অনটন, বিষয়ক্ষুধা দেখেছি। দিশাহারা হয়ে লক্ষ্যচ্যুত হতে দেখেছি। সেসব সাধারণ ঘটনা নয়।

- সেতো জীবন থেকে তত্ত্ব - আমরা চাইছিলাম সরাসরি শুখাখরা জীবনের এক্সপ্লোশন।

- তুমি নিশ্চই ইমলিতলা-দরিয়াপুরের পরিবেশের কথা বলছ ?

- ঠিক তাই। ইমলিতলার সীমানা-নকশা, খাদ-খোঁদল, আধন্যাংটা মানুষ, কীটপতঙ্গ - ধারাবর্ষণের দিন, উৎসবের দিন --

- অপেক্ষা করো। সবে তো 'মেথিশাকের গল্প' হল। গল্পের মধ্যে গল্প 'খুল যা সিমসিম' প্রাত্যহিকতার ফসল।  এই গ্রন্থে আছে ৩১টি গল্প। সবই জটিলতায় ঘেরা - লোভ, লিপ্সা, তুরিয়ানন্দ।  ক্ষমতার উৎসে যারা, তাদের বোলবোলা দিনকে দিন বাড়ছে।

- তার মধ্যে তুমিও তো আছো ? তোমার অবস্থান বদলায়নি ?

- না রবীন্দ্র, কোন কিছুর প্রতি আমার লোভ, লিপ্সা, মোহ নেই।

- তবু লোকে তো বলে তুমি ঘনঘন ভোল পাল্টাও। হাংরি করেছো, আবার অধুনান্তিকও করছ। পাটনায় থাকতে বামপন্থী সাহিত্য করতে।

- হ্যাঁ, আমি প্রগতি সাহিত্য করতুম।  সাম্যে বিশ্বাস করি। চিন্তা ভাবনায় কোনো বদল ঘটেনি। রাজনেতারা অনবরত বলে, মানুষ চায়, তাই মানুষের জন্য করছি। লেখক কি তা বলতে পারেন, মানুষ চায়, তাই এইসব ক্লিশে ব্যাপার-স্যাপার লিখছি ? আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, সংসারে যে জীবন ভালোবাসার জীবন, তা সংকট সৃষ্টি করে না, সংকটমুক্তির পথ দেখায়।

রাইজোমেটিক চলন-বলনের মাধ্যমে স্থান পরিসরের ফাটলে দাঁড়িয়ে সমীরের চরিত্ররা খাঁটি যুক্তিময়তায় দৃঢ় থেকেছে। ফলে, তারা হৃদয়ের এত কাছাকাছি। সমাচ্ছন্ন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে ভালোবাসার ঐক্যে অবস্থাপন্ন।  নিজের মত অন্য আরো অনেকের মত সমীর তার আস্থা বিশ্বাসময়তা দিয়ে একটি প্রেক্ষিত গড়ে তোলে, এবং সে, সমীর, সেই প্রেক্ষিতের প্রতিনিধি।

তখনো সমীরের শরীর ততটা ভাঙেনি। বেশ শক্তসমর্থ। একদিন বললো, চলো মলয়ের ওখানে যাই। আমরা মলয়ের নাকতলার বাড়িতে গেলাম। জমিয়ে আড্ডা হলো ঘণ্টা তিনেক। সমীর বললো - ভাবছি, 'হাওয়া ৪৯'-এর একটা সংখ্যা বার করব- 'ভবিষ্যতের গল্প'। অসম্ভবকে ধরতে হবে। পতন ঘটলেও ক্ষতি নেই।

- কি রকম, একটু খুলে বলো ?

- ভবিষ্যতের মানুষ ও তার জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা বিষয়ে আজকের গল্পকারদের ভাবনাচিন্তার কিছু বাকফসল ও অবাক ফসল। প্রত্যেক গল্পকার নিজের মত করে ভবতরঙ্গের খুঁটি ধরে এগোচ্ছেন অনাগত ভবপরিসরের দিকে।

- তোমার ভাবনার কদর করছি। কাজটা কঠিন।

- তা তো বটেই।  'ভ' অক্ষরের অর্থময়তার উৎস কি জানো ? ভর ও ভরণ। ভক্ষ্য ও ভক্ষণ। লেখক সৃষ্টির কথাও বলতে পারে, বিনাশের কথাও বলতে পারে, আবার সতর্কতার কথাও বলতে পারে। মহাকাশে ঘর খোঁজার কথাও বলতে পারে।

আমরা লিখলাম - আমি, নবারুণ ভট্টাচার্য, নীলাঞ্জন চট্যোপাধ্যায়, অসীম ত্রিবেদী, মুর্শিদ এ এম, রামকিশোর ভট্টাচার্য, কামাল হোসেন।

সমীরের মাথায় আরো কতরকম পরিকল্পনা ছিল, যেমন - ভারতীয় বোধ ও চেতনার স্বরূপ। এমন সব তরুণ-লেখক খুঁজে বেড়াত যাদের ব্রহ্মাণ্ড ও কলাবিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞান আছে, অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বিষয়ে চর্চা আছে। যারা সেই সব বিষয় নিয়ে লিখতে পারে। শুধু 'হাওয়া ৪৯' নয় অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদেরও উৎসাহ দিত।

প্রায়ই ফোন করে বলত - "গ্লোবালাইজেশন নিয়ে কি ভাবছ ? জটিলতা লক্ষ্য করনি ? সমাজ জীবনে কেওয়স ? যত মজা ততটাই দ্বন্দ্ব-বিরোধ। নতুনদের লেখায় এসব আনতে বলো। আমি ভাবছি এই নিয়ে একটা সংখ্যা করব। তুমি একটা গদ্য তৈরী কর, মলয়ের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।

মহাশূন্যে ঘর খোঁজার কথা বলল একদিন। অনেক হাঁ-মুখ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। টলমল করছে অন্যপৃথিবী।

 - 'হাওয়া ৪৯' জট ছাড়াতে চায় অসত্য, অধর্ম ও না-ধারার। একদিন এসো না ; এই নিয়ে কথা হবে।

সমীরের মাথায় কত যে চিন্তা। বলত, যৌনতার লজ্জা, যৌনতার বাড়াবাড়ি এ-নিয়ে তো অনেক কথা হল। অন্য কিছু ভাবা যায় না ? ক্রমবিবর্তনের কথা ? স্বচরিত্রে বিশিষ্ট কিছু ? মনের মধ্যে মন, দুঃখচেতনা, আরোপিত বর্ণভেদ ? সমীর মূলস্রোতের বাইরে টেনে আনতে চেয়েছিল 'হাওয়া ৪৯' কে।

সমীর বিশ্বাস করত না আমাদের বাংলা-সাহিত্যে আদৌ কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। যদিও বাংলা সাহিত্যের আকাশ নক্ষত্র খচিত। আত্মহত্যা থেকে শুরু করে প্রেমে অস্থিরতা- দ্বন্দ্বউত্তেজনা- বিপজ্জনক মৃত্যু- শরীরী-তৃষ্ণা গতে বাঁধা। না, আবেগের কথা নয়, সময়ের দাপট বাড়ছে, তা মানতে হবে।

- জানো রবীন্দ্র, মাঝে মাঝেই আমাকে আরো একটা বিষয় খুব ভাবায় 'অবাস্তবের বাস্তবতা'- মানে, স্বপ্ন কল্পনা কিংবদন্তি। আমার কোনো কোনো স্বপ্ন ভয়ঙ্কর ভাবে বাস্তব। এই নিয়ে 'হাওয়া ৪৯'এর একটা সংখ্যা করা যায় না ?

- নিশ্চই যায়

খুব জোর দিয়ে বললাম বটে, কিন্তু অবাস্তবের বাস্তবতার মায়াজাদু আর জানা হল না। মসীলিপ্ত হয়ে রইল বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্পদ। বহুকাঙ্খিত বদলকরণের দিগন্তরেখায় আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে সমীর অদৃশ্য হল অবাস্তবের বাস্তবতায়।